কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি, আবার কখনও ভারি বৃষ্টি। এর মধ্যেই গতকাল রোববার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় টিকাকেন্দ্রের সামনে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। ওই এলাকার বাসিন্দা মর্জিনা বেগম লাইনে দাঁড়িয়েছেন সকাল ৭টায়। টিকা না পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় ফিরে যান। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে দিনশেষে অনেক মানুষকেই টিকা ছাড়া ফিরতে হয়েছে। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই গতকাল রোববার টিকার চেয়ে মানুষ ছিল দ্বিগুণ বা কয়েকগুন।
রাজধানীতে গণটিকাদানের জন্য প্রতিটি টিকাকেন্দ্রে দৈনিক ৩৫০ ডোজ টিকা বরাদ্দ রয়েছে। পল্লবীর ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টার কেন্দ্রে টিকা নেওয়ার জন্য ৫০০-৬০০ লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফজরের নামাজের পর এসে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকা পাননি বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। টিকা নিতে আসা ব্যবসায়ী কামরুল হাসান বাবু বলেন, দৈনিক মাত্র সাড়ে তিনশ টিকা দিলে এ অবস্থা হবে- এটাই স্বাভাবিক। ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন বলেন, লাইনের বাইরে কাউকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না। হাজার হাজার লোক আসছে টিকা নিতে। কিন্তু টিকা আছে মাত্র সাড়ে তিনশ; বিশৃঙ্খলা তো হবেই।
রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডার পূর্বাঞ্চল সড়কের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে শত শত মানুষ টিকা নিতে ভোরে এসে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকা না পেয়ে ফিরে গেছেন। তাদের অভিযোগ, সিরিয়ালে দাঁড়ানোদের টিকা না দিয়ে প্রভাবশালীরা নিজেদের 'কাউন্সিলরের লোক' পরিচয় দিয়ে পরে এসেও টিকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে সিরিয়ালে দাঁড়ানো মানুষ টিকা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে কেন্দ্রের সুপারভাইজার মহসিন আলী বলেন, সিরিয়াল ধরে যারা ভেতরে আসছেন, তাদের নিবন্ধন করিয়ে টিকা দিয়ে কার্ড দিচ্ছেন। বাইরে কোনো অনিয়মের খবর তার জানা নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের শেওড়াপাড়া টিকাকেন্দ্রে রোববার ভোর থেকেই মানুষের ঢল নামে। সময় যত গড়ায়, লাইন ততই দীর্ঘতর হতে থাকে। ভিড় সামলাতে গলদঘর্ম হয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরাও।
তবে এ কেন্দ্রে অনেককে টিকা নিয়ে হাসিমুখে বের হতে দেখা গেছে। টিকা নেওয়া গৃহিণী রাজিয়া সুলতানা বলেন, 'সাড়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। অপেক্ষার পরও টিকা পেয়ে আমি খুশি।' ষাটোর্ধ্ব রফিক উল্যাহ বলেন, কীভাবে টিকার আবেদন করতে হয়, জানতাম না। এখন এই সুযোগে টিকা নিয়ে নিলাম।
ধানমন্ডি লেকের পাড়ে ডিঙি রেস্টুরেন্টের পাশে টিকাকেন্দ্রে গতকাল রোববার প্রচণ্ড ভিড়ে হট্টগোলের কারণে নির্ধারিত সময়ের ৪০ মিনিট পর টিকা দেওয়া শুরু হয়। এখানে টিকা নিতে আসা বেশিরভাগ মানুষই জানান, তথ্যের ঘাটতির কারণে তারা ভোগান্তিতে পড়েছেন। কেন্দ্রের সামনে উল্লেখ করা উচিত ছিল, কোন ওয়ার্ডের মানুষ এখানে টিকা পাবেন। বলা হচ্ছে, প্রচুর টিকা আছে; কিন্তু নিবন্ধনের ১০ থেকে ১৫ দিন হলেও এসএমএস আসছে না।
রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরে জান্নাত একাডেমি হাই স্কুল কেন্দ্রে গতকাল রোববার যথারীতি ৩৫০ ডোজ টিকা আনা হয়েছিল। টিকাদান কার্যক্রম শুরুর আড়াই ঘণ্টার মাথায় টিকা শেষ হয়ে যায়। ফলে অনেকেই টিকা না পেয়ে ফিরে যান। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকা দেওয়ার দায়িত্ব পাওয়া সূর্যের হাসি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী নাজমুন্নাহার বলেন, টিকার তুলনায় মানুষের চাপ অনেক বেশি। তারা সকাল ৯টায় টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছেন। সাড়ে ১১টার মধ্যে টিকা শেষ হয়ে যায়।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন টিকাকেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, টিকা নেওয়ার পর বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। টিকা দেওয়ার পরই লোকজন বেরিয়ে গেছেন। বয়স্কদের জন্য আলাদা লাইন নেই। গণটিকা কোন কেন্দ্রে কারা পাবেন, সে তথ্যও দেওয়া হয়নি। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে টিকাকেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার উপায় ছিল না। ছিল ভিড়, হুড়োহুড়ি ও বিশৃঙ্খলা। লাইন ভেঙে টিকা নেওয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, লাইন ছাড়াই বিশৃঙ্খলভাবে টিকা দেওয়াসহ নানা অনিয়ম চোখে পড়ে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি ওয়ার্ডে দিনে ৩৫০ জনকে দেওয়ার মতো টিকা বরাদ্দ থাকায় অনেক মানুষকে টিকা না নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে। ১২ আগস্ট পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, যারা টিকা পাচ্ছে না, আমরা তাদের আশ্বস্ত করছি। তারাও টিকা পাবে। ছয় দিন চলবে গণটিকাদান কর্মসূচি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, তাদের ৭৫টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ছয় দিন ধরে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩৫০ জনকে টিকা দেওয়া হবে।
এদিকে, গতকাল রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম এসএমএস না পেয়ে করোনা টিকাদান কেন্দ্রে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এসএমএস না পেয়ে অনেকেই টিকাদান কেন্দ্রে ভিড় করছেন। অনেক কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে না। ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।