নানা শঙ্কা কাটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছে বিএনপি। এতে দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ঢল নামে। গণসমাবেশের আগের রাতেই প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠ।
শনিবার সকাল ৬টা থেকে আরও আসতে শুরু করেন বিভাগীয় সব জেলার নেতাকর্মীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকাল ১০টার মধ্যেই তা মাঠ ছাড়িয়ে সামনের সড়কে ছড়িয়ে পড়ে।
একদিকে বাসাবো ফ্লাইওভার এবং অন্যদিকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে যায় নেতাকর্মীদের ভিড়। সড়কের দুপাশও কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এছাড়াও সমাবেশস্থলের আশপাশের অলিগতিতে অবস্থান নেন নেতাকর্মীরা।
বিএনপির সবশেষ ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই নানা শঙ্কা ছিল। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় বিএনপি। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
এ নিয়ে বিএনপি ও পুলিশ মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। বিএনপির নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে অবস্থান নেওয়া শুরু করলে বুধবার সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা নিহত ও শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। পুলিশ নয়াপল্টন কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে চেয়াপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে।
পরদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও নয়াপল্টনের বাইরে বিকল্প স্থানে গণসমাবেশ করা নিয়ে বিএনপি ও পুলিশ একমত হয়। এ নিয়ে সমাঝোতারও চেষ্টা চলে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণসমাবেশ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার করার পর গণসমাবেশ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। পরে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শুক্রবার দুপুরের পর গোলাপবাগ মাঠে অনুমতি দেওয়া হয়।
শনিবার সকাল ৯টার দিকে গোলাপবাগ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কানায় কানায় পরিপূর্ণ মাঠ। নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাসও চোখে পড়ে। তবে অনেক নেতাকর্মী জানান, জীবন বাজি রেখে এই সমাবেশে এসেছেন। পথে পথে নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা মহিদুর রহমান নামের এক নেতা জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত রয়েছি। টাঙ্গাইল জেলা থেকে আসা মহিলা দলের নেত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, তিনিও আসার পথে অন্তত তিন জায়গায় পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়তে হয়েছে। জনদাবি নিয়ে বিএনপির এ গণসমাবেশ, তাই নিজের তাগিদেই অংশ নিয়েছেন।
রাতে অবস্থান করা নেতাকর্মীরা জানান, গোলাপবাগ মাঠের উত্তর পাশে বড় পর্দায় তারা আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ও ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের খেলা দেখেন। কদমতলী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নাছির মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা উপভোগ করেন। শীতের মধ্যে একদিকে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ মিছিল, অপরদিকে অনেকে আবার খেলাও উপভোগ করেন।
সকাল সোয়া ১০টায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় গণসমাবেশ। এতে ঢাকা বিভাগীয় ১১ সাংগঠনিক জেলার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য জেলার নেতাকর্মীদের দেখা যায়। সকাল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা অংশ নেন। নেতাকর্মীরা নানা রংয়ের ক্যাপ ও টি-শার্ট পরে অংশ নেন। মাঠে শমসের আলী নামের ষাটোর্ধ একজনকে লুঙি ও জামা পরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায়। তিনি জানান, নরসিংদীর মনোহরদী থেকে দুদিন আগে রাজধানীতে আসেন। তিনি সাধারণ মানুষ। ঢাকার গণসমাবেশে যোগ দিয়েছেন বিএনপির দাবিকে সমর্থন জানাতে।
শমসের আলী বলেন, স্ত্রীসহ চারজনের সংসার তার। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সংসার চালাতে পারছেন না। বিএনপির এ কর্মসূচির মাধ্যমে যদি কোনো পরিবর্তন হয় সে আশায় তিনি অংশ নিয়েছেন।
এছাড়াও সমাবেশস্থল ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরের দলীয় নেতাকর্মীই বেশি। আশপাশের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা জেলার নেতাকর্মীও ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও ঝিনাইদহ, বরিশাল, সিলেটসহ অন্য জেলা থেকে অনেকে আসেন। কাফনের কাপড় পরে সিলেট থেকে শাহজাহান নামের এক ছাত্রদল কর্মীকে অংশ নিতে দেখা যায়।
তিনি জানান, অনেক শঙ্কার মধ্যে তিনি গণসমাবেশে এসেছেন। জীবন দিতেও প্রস্তুত-এই মনোবল নিয়ে কাফনের কাপড় পরেই এসেছি। ঢাকা মহানগরের মনজিল ইসলাম নামের এক যুবদল নেতা জানান, এই সমাবেশ সফল করাই ছিল চ্যালেঞ্জ। আমরা লাখো মানুষের এই সমাবেশ করে প্রমাণ করেছি বিএনপির দাবির প্রতি জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এছাড়াও অনেককে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে মুহুর্মুহ স্লোগানে মুখর করে তোলেন সমাবেশস্থল। যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে স্বেচ্ছাসেবকরাও সোচ্চার ছিলেন।