দেশের যেকোনো সময়ের চেয়ে আমানতের সুদহার এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। বলা যায়, মূল্যস্ফীতির নিচে নেমে গেছে আমানতকারীদের মুনাফার হার। এতে ব্যাংকে আমানত রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমানতকারীরা। বছর শেষে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তাদের মূলধন। এমনি পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের ক্ষতি পোষাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার তিন মাস মেয়াদি ও তার ঊর্ধ্বে আমানতের ন্যূনতম সুদহার বেঁধে দিয়েছে। বলা হয়েছে এসব মেয়াদি আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির নিচে নামানো যাবে না। এটা নির্ধারণে তিন মাস আগের মূল্যস্ফীতির হারকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ ধরনের নতুন একটি নির্দেশনা গতকালই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীকে অবহিত করেছে। এর ফলে দীর্ঘ এক বছর পর ঋণের পর আমানতের ন্যূনতম সুদহার বেঁধে দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যাংকগুলো নতুন কোনো বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যেটুকু বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার প্রণোদনা কর্মসূচির আওতার মধ্যেই সীমিত রাখছে। এতে ব্যাংকের অলস টাকার পাহাড় জমে গেছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতমালা শিথিলতার কারণে গত প্রায় দেড় বছর ব্যাংকগুলো ঋণও আদায় করতে পারেনি। অপর দিকে বাড়তি মুনাফা অর্জনের চাপ রয়েছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর। বাধ্য হয়ে পরিচালনব্যয় কমিয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য আমানতকারীদের ওপরই হাত দিচ্ছে বেশির ভাগ ব্যাংক। জুন শেষে আমানতের গড় সুদহার ৪ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের ইতিহাসে আর কখনো আমানতের সুদহার এত নিচে নামেনি। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমছে সে পরিমাণ মুনাফাও পাচ্ছেন না আমানতকারী। এতে লোকসানে পড়ছেন তারা। এর উপরে এক্সসাইজ ডিউটি (আবগারি শুল্ক) ও অন্যান্য চার্জের খড়গ তো আছেই। এমনি পরিস্থিতিতে সাধারণ গ্রাহকের আমানত পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতিরে নিচে নেমে আসায় প্রকৃতপক্ষে আমানতকারীরা ব্যাংকে অর্থ রেখে মূলধন হারাচ্ছেন। তারা বাড়তি মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখকর হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জুন শেষে আমানতের গড় সুদহার ৪ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে গেছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। যেখানে মূল্যস্ফীতির হার (পয়েন্ট টু পয়েন্ট) গত এপ্রিলে ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতেই মূলত আমানতের সুদহার কমিয়ে দিচ্ছে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানতের সুদের হার শুধু নিচে নেমেছে তাই নয়, মূল্যস্ফীতির থেকেও নিচে নেমে গেছে। যা খুবই বিপজ্জনক। এতে আমানতকারীরা ব্যাংকের আমানত রাখার ক্ষেত্রে বিমুখ হবেন। যা ব্যাংকিং খাতের জন্য ভালো নয়। আর মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারালে পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমানতের সুদহার অনেক কম হলেও তাদের ওখানে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চলে। অর্থনীতি সচল রাখতে বিভিন্ন পথ (টুলস) তারা ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের এখানে সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এখানে আমানতের সুদের হার কমে গেলে তাতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এ পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারলে মানুষ বাড়িঘর কেনার মতো জায়গায় বিনিয়োগ করবে কেউ ব্যাংকে আমানত রাখবে না। এ জন্য নতুন নতুন বিনিয়োগের জায়গা খুঁজে বের করার পরামর্শ তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণে অলস টাকা পড়ে আছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছে না। আবার খেলাপি ঋণেও পরিমাণও বিশাল। অন্য দিকে সরকারও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ না করে উল্টো ধার শোধ করছে। ব্যাংকগুলোর হাতে গত জুন শেষে অলস অর্থ রয়েছে (আমানতের বিপরীতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার বা সিআরআর অতিরিক্ত) ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এত সমস্যার পরও ব্যাংকগুলোতে বছর শেষে মুনাফা অর্জন করতে হবে। ব্যাংকের যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যত বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারে সে এমডি ভালো হিসাবে ধরা হয়। ফলে, সবকিছু মেনে নিয়ে বছর শেষে মুনাফা অর্জনই ব্যাংকগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকছে। এতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেদিকে খেয়াল করছে না ব্যাংকগুলো।
এমনই পরিস্থিতিতে আমানতের ন্যূনতম সুদহার বেঁধে দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেয়া ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদ বা মুনাফা হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ ব্যাংক কর্তৃক মেয়াদি আমানতের ওপর মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম হারে সুদ বা মুনাফা প্রদান করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র আমানতকারীসহ অন্যান্য আমানতকারীদের একটি অংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের সুদ বা মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। ব্যাংকে রক্ষিত মেয়াদি আমানতের ওপর মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম হারে সুদ বা মুনাফা প্রদান করায় আমানতকারীদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তা ছাড়া, মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা হার অত্যধিক হ্রাস জনসাধারণের সঞ্চয়প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করে। ফলে আমানতকারীগণ কর্তৃক তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ খাতসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে।
উল্লেখ্য, ব্যাংক-তহবিলের প্রধান উৎস হলো বিভিন্ন ধরনের আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত। আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা হার অতিমাত্রায় হ্রাস পেলে ভবিষ্যতে ব্যাংকের আমানতের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। ফলে, ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে।
এমনই প্রেক্ষাপটে, আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং ব্যাংকিং খাতে দায়-সম্পদ এর ভারসাম্যহীনতা রোধকল্পে তিন মাস ও তদূর্ধ্ব মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে। নতুন নির্দেশনা মোতাবেক ব্যক্তিপর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিবিধ পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত যেকোনো পরিমাণ মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা হার মূল্যস্ফীতি হার অপেক্ষা কোনোক্রমেই কম নির্ধারণ করা যাবে না। আমানতের ওপর কোনো নির্দিষ্ট মাসে সুদ বা মুনাফা হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওই মাসের অব্যবহিত তিন মাস আগের মূল্যস্ফীতি হারকে (বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ১২ মাসভিত্তিক গড়) বিবেচনায় নিতে হবে। একই সাথে ঋণ বা বিনিয়োগের ওপর সুদ বা মুনাফার হার অর্থাৎ ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে। প্রসঙ্গত, গত বছরের শুরুতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।