করোনার এই ক্রান্তিকালের মধ্যেই ক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। আগের দিন সকাল ৮টা থেকে গতকাল বুধবার একই সময় পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ২৩৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একই সময়ে মারা গেছেন ৪ জন। এ নিয়ে দেশে গত চারদিনে হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করছে, আগামী দিনগুলোয় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ রূপ নিতে পারে। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে তেমনটি হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে যে বাড়তি চাপ পড়বে তা সামলানো মারাত্মক কঠিন হবে।
গতকাল বুধবার নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও আশঙ্কাজনক রূপ নিতে পারে। বর্ষাকালে আমরা কয়েক বছর ধরেই দেখেছি এডিসবাহিত যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি, সেটি সময় সময় অত্যন্ত আশঙ্কাজনক
রূপ নিয়েছে। ২০১৯ সালে আমরা দেখেছি ডেঙ্গু মহামারী আমাদের কীভাবে আক্রান্ত করেছিল। ২০২১ সালে এসে একই রকম একটি পরিস্থিতির মুখে আমরা দাঁড়িয়েছি। আমরা মনে করি, দ্রুত ব্যবস্থা নিলে সেটি মোকাবিলা করতে পারব।
গত কয়েকদিনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় রাজধানীতে এখন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন এই রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এই আক্রান্তদের অনেক ছুটছেন হাসপাতালে; আবার কেউ ছুটছেন চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারে। রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন তাদের তথ্য সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৪১টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া রাজধানীর বাইরে ৮টি বিভাগ থেকেও ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এই তথ্য বলছে, গত ১ থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী। অর্থাৎ চারদিনে প্রতিদিন গড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৫৬ জনের বেশি।
কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৬৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী রাজধানী এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জন মারা গেছেন। অবশিষ্ট রোগীদের ১ হাজার ৫৮ জন চিকিৎসাধীন আর সুস্থ হয়ে ২ হাজার ৬১৭ জন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২ হাজার ২৮৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, মারা যান ৪ জন। আর এ মাসের প্রথম চারদিনেই রোগীর সংখ্যা সহস্রাধিক আর ৪ জনের মৃত্যু হলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর জুন থেকেই ডেঙ্গুজ¦রের রোগী বাড়তে শুরু করেছে। বিগত বছরগুলোয় জুন মাসের তুলনায় জুলাই আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুজ্বরে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবারও একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে চলতি আগস্ট মাসে আক্রান্তের হার অনেক বেড়ে যেতে পারে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। অর্থাৎ এখন ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম। কারও জ্বর হলে তাকে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ডেঙ্গুজ্বরের বিষয়টি স্মরণে রাখতে হবে। যদি কারও সর্দি, জ¦র, মাথাব্যথা, গলাব্যথার মতো উপসর্গ থাকে তা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করোনা ও ডেঙ্গুর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। কারও জ্বর থাকলে তিনি নিজে নিজে পরীক্ষা করবেন না, ওষুধ খাবেন না, চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। যাদের প্লাটিলেট কমে ১ লাখের নিচে নেমে যায় তাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। যারা প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের থেকে যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে তাদের জটিলতা বেশি হয়। তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। এ ছাড়া যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও লিভার রোগ রয়েছে তাদেরও ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যুঝুঁকি থাকে। এ ধরনের রোগীদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে এডিস মশা যেন বংশবিস্তার করতে না পারে, সে জন্য ঘরের ভেতর ও বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না। দিনের বেলায় বাসাবাড়িতে মশানাশক স্প্রে করে দরজা-জানালা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখতে হবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে মশানিধনে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়েও রাজধানীজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে যাদের বাসায় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে তাদের মধ্যে আতঙ্ক বেশি। বড় মগবাজারের বাসিন্দা মিনারা সিদ্দিকী বলেন, ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম তাই বাচ্চাকে নিচে খেলতে যেতে দিচ্ছি না। আশপাশের বাসার কেউ কেউ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। বাচ্চাকে নিয়ে খুব টেনশনে আছি। ডেঙ্গুজ্বর থেকে বাঁচাতে বেডরুমে অ্যারোসল স্প্রে করে সারাদিন দরজা-জানালা বন্ধ রেখে বাচ্চাকে সেখানে খেলতে দেই। বাসায় নিয়মিত অ্যারোসল স্প্রে ও মশারি ব্যবহার করছি। মেয়ে বিকালে পড়ার সময় যাতে পায়ে মশা বসতে না পারে, সেজন্য টেবিলের নিচে ইলেক্ট্রিক কয়েল ও স্ট্যান্ডফ্যান দিয়েছি। তার পরও টেনশনে আছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন বাচ্চাকে সুস্থ রাখেন।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বছরে কয়েকবার এডিস মশার জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চ মাসে জরিপে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশকিছু এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহৃত সূচকের মাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব এলাকার তালিকা সিটি করপোরেশনে পাঠানো হয়েছে। সিটি করপোরেশন সেখানে মশানিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। গতকাল সকালে খিলগাঁওয়ের পিডব্লিউডি কলোনিতে মশকনিধন কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি জানান, চিরুনি অভিযানে এডিস নিয়ন্ত্রণে আসবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। তাপস বলেন, আমাদের এলাকায় যে সরকারি আবাসনগুলো আছে, আমরা তাদের বারবার চিঠি দিয়েছি, সতর্ক করেছি। আমরা বলেছি, যেন তারা সেগুলো পরিষ্কার করেন। আপনারা লক্ষ্য করেছেন, আজকেও আমি পরিদর্শনে এসে দেখলাম, এখানে লার্ভা পাওয়া গেছে। এটি আসলে খুবই দুঃখজনক। আমরা যদি নিজেরা নিজেদের এলাকা পরিষ্কার-পরিছন্ন না রাখি, উৎসগুলো নিধন না করি, কোনো আধারে যেন পানি না জমতে না পারে, সে বিষয়ে সচেতন না হন তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত দুরূহ। তার পরও আমরা কাজ করে চলেছি। আমরা আশাবাদী, এই চিরুনি অভিযানের ফলে এডিস মশার বিস্তার আমরা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারব। যদি সবাই দায়িত্বশীলভাবে কাজ করি, তা হলে এটার বিস্তার এতদূর হতে পারে না।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বেও বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গতকাল ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে সপ্তাহব্যাপী চিরুনী অভিযান ও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হয়। সপ্তাহব্যাপী এই কার্যক্রম চলবে আগামী ৮ আগস্ট পর্যন্ত। কর্মসূচি শেষে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, মেয়র আতিকুল ইসলামের দিকনির্দেশনায় সব ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে নানামুখী কার্যক্রম চলছে। ওয়ার্ডবাসীর প্রতি অনুরোধ, নিজের ঘরবাড়ির জমানো পানি পরিষ্কার করাসহ ফুলের টপ, বাড়ির ছাদ, আঙ্গিনায় যাতে মশার কোনো লার্ভা না জন্মে- সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নগরবাসীর কারও কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে উত্তর সিটি করপোরেশন সব সময় প্রস্তুত রয়েছে।
ডেঙ্গু যে শুধু রাজধানীতেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এমন নয়। এখন নিয়মিতই রোগী এখন পাওয়া যাচ্ছে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বাইরে ১৬ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলা, খুলনা বিভাগের যশোর জেলা, রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ জেলা, বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার রোগী রয়েছেন।