বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার টানা ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে গত ২৩ জুলাই। এরপর বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল থাকায় প্রায় লাখো জেলে ১২ দিন মাছ ধরতে সাগরে নামতে পারেননি। সাগর শান্ত হওয়ার পর ৪ আগস্ট থেকে জেলার অন্তত ছয় হাজার ট্রলারে করে মাছ ধরতে নেমেছেন জেলেরা।
তবে টেকনাফের জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, নাইট্যংপাড়া, লেদা, দমদমিয়া, হ্নীলা, মৌলভীবাজার, হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, পালংখালী, বালুখালী এলাকার অন্তত ১০ হাজার জেলে মাছ ধরতে যেতে পারছেন না নাফ নদীতে নিষেধাজ্ঞা কারণে। অথচ তাঁরা কয়েক যুগ ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। এখন তাঁদের জীবিকায় টান পড়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর নাফ নদীর পার হয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। তখন রোহিঙ্গার ঢল ও ইয়াবা পাচার থামানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করে নাফ নদীতে মাছ নিষিদ্ধ করা হয়। চার বছর ধরে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি।
জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল গণি বলেন, চার বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জেলেদের কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি দুই শতাধিক নৌযান ও মাছ ধরার জাল নষ্ট হচ্ছে। জেলে পরিবারগুলোর অমানবিক জীবনযাপনের কথা বিবেচনা করে কয়েক মাস আগে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ফলে জেলেদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
কক্সবাজার থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ। সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার গেলে জালিয়াপাড়া। এ পাড়ার লোকসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। বেশির ভাগই জেলে। এ পাড়ার বাসিন্দা জেলে আমান উল্লাহ। তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ শিকার করে সংসার চালাচ্ছিলেন। নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে আছেন তিনি।
আজ শুক্রবার সকালে জালিয়াপাড়া বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে আমান উল্লাহ বলেন, লাখো জেলে খুশি মনে ইলিশ ধরতে নেমেছেন সাগরে। অনেকের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, কোরাল, লাক্ষ্যা, রুপচাঁদা, চাপাসহ নানা সামুদ্রিক মাছ। কয়েক দিন পর এ মাছে সয়লাব হবে হাটবাজার। হাসি ফুটবে অনেক জেলের মুখে। কিন্তু তাঁদের কপাল খারাপ, সাগর অথবা নাফ নদীতে নেমে মাছ ধরার অধিকার নেই তাঁদের। বাংলাদেশি নাগরিক হলে কী হবে, তাঁদের অবস্থা রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ।
চার বছর ধরে জেলেপল্লির হাজারো মানুষ বেকার বলে জানালেন আমান উল্লাহর প্রতিবেশী আবদুল গাফফার ও সখিনা খাতুন। তাঁরা জানান, কোনোমতে জীবন চলছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত জেলেরা। জেলেদের পাশে কেউ নেই।
নাফ নদী দিয়ে ইয়াবা পাচার বন্ধে স্থানীয় জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন টেকনাফের নাইট্যংপাড়ার জেলে নবী হোসেন। তিনি বলেন, ইয়াবা পাচার তো বন্ধ হয়নি। বরং ইয়াবার বড় বড় চালান ধরা পড়ছে। ইয়াবা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো জেলে ধরা পড়েননি। তাহলে কার স্বার্থে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরতে দেওয়া হচ্ছে না?
লেদা এলাকার জেলে কবির আহমদ বলেন, নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হলেও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে পারছেন অন্য জেলেরা। বঙ্গোপসাগর দিয়েই তো বেশির ভাগ ইয়াবার চালান ঢুকছে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার, মহেশখালীসহ বিভিন্ন উপকূলে। সেসব জায়গায় তো মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়নি।২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর নাফ নদীর পার হয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। তখন রোহিঙ্গার ঢল ও ইয়াবা পাচার থামানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করে নাফ নদীতে মাছ নিষিদ্ধ করা হয়। চার বছর ধরে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি।
হ্নীলার জেলে আবদুল শুক্কুর বলেন, জেলেপল্লির ১০ হাজার মানুষের সংসার কীভাবে চলছে, তার খবর প্রশাসনের রাখা উচিত।
চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জেলেপল্লির ঘরে ঘরে অভাব বলে জানালেন নাইট্যংপাড়ার জেলে নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, অভাব তাঁদের লজ্জাশরম কেড়ে নিয়েছে। সন্তানদের চেহারার দিকে তাকালে চোখে জল আসে। অধিকাংশ ঘরে ঠিকমতো চুলাও জ্বলছে না।
নাফ নদীতে মাছ ধরতে না পেরে জেলেরা বিপদে আছেন বলে মন্তব্য করেন টেকনাফ উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, জেলেদের দুর্ভোগ লাঘবে মাছ ধরতে দেওয়ার একটা পথ বের করার চেষ্টা চলছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাহেদ হোসেন বলেন, ইয়াবা, চোরাচালান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকার নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে ঠিক, কিন্তু ইয়াবা পাচার বন্ধ হচ্ছে না। কয়েক হাজার জেলে পরিবারের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে সরকারি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা দরকার।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী বলেন, নাফ নদীতে মাছ ধরার সুযোগ চেয়ে জেলেরা বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ চলছে।