রাজপথে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলেছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে বাধ্য করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগেই সরকারকে বিদায় করতে হবে। পাশাপাশি দল গুছিয়ে এখন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
মঙ্গলবার বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে সিরিজ বৈঠকের প্রথম দিন তারা এই মত দেন। বিকাল ৪টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বৈঠক শুরু হয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চলে। মাগরিবের নামাজের জন্য ২০ মিনিট বিরতি দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন তিনি।
বৈঠক সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির কী করা উচিত, আন্দোলনের কর্মকৌশল কী হওয়া উচিত, মাঠ পর্যায়ের সংগঠনকে আরও সক্রিয় করতে কী করা প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে নেতারা মত দেন। তারা বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন করা যাবে না। নির্বাচনে জিততে হলে নির্বাচনের আগেই জিততে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন না ঘটালে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মতো ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করবে। নেতারা আরও বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে দলের পক্ষ থেকে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তাকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।’
জোটের রাজনীতি বিশেষ করে জামায়াত ইস্যুতে দলের অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি জানান কেউ কেউ। দুজন উপদেষ্টা ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান জামায়াত ইস্যুতে কথা বলেন। তারা জানান, জামায়াতের সঙ্গে জোট করায় বিএনপিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এখনই তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দল পুনর্গঠন নিয়েও কথা বলেন বেশির ভাগ নেতা। তারা বলেন, ‘আন্দোলনের জন্য দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু নানা কারণে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া গতি আসছে না।’
তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এটাই কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে সবচেয়ে বড় বৈঠক। নেতাদের বক্তব্যে শুনে তারেক রহমান দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেন। ব্যক্তিগত কাজ থাকায় বৈঠক চলাকালে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমদসহ দুই-তিনজন নেতা চলে যান। বৈঠকের বিষয় নিয়ে বাইরে কথা না বলার জন্য উপস্থিত নেতাদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়। যে কারণে বৈঠক শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো নেতা কথা বলেনি।
এদিকে বিএনপির ধারাবাহিক বৈঠককে কেন্দ্র করে দীর্ঘ দিন পর সরগরম হয়ে ওঠে গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়। দলীয় পতাকা উত্তোলন হয়। পরিপাটি করে গোছানো হয় পুরো কার্যালয়। ভবনের নিচতলার হলরুমে নেতাদের সাদা কাপড়ে মোড়ানো আসন দেওয়া হয়। ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চের সারিতে বসেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। স্ক্রিনে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিন দিনের সিরিজ বৈঠকের প্রথম দিন মঙ্গলবার দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানরা অংশ নেন। আজ নির্বাহী কমিটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, যুগ্ম-মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকদের নিয়ে বৈঠক হবে। আগামীকাল অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে হবে বৈঠক। ইতোমধ্যে সাড়ে তিনশ নেতাকর্মীকে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি।
প্রথম দিনের বৈঠকে দলটির ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ ও ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে ৬২ জন যোগ দেন। অসুস্থ থাকায় কয়েকজন আসতে পারেননি। এ ছাড়া মারাও গেছেন কয়েকজন। প্রতিটি বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন। তবে বৈঠকে সবাইকে বাধ্যতামূলক থাকতে হবে এমন কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা পর্যায়ক্রমে অংশ নেবেন। বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য-ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন। ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও সেলিমা রহমান অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। মির্জা আব্বাস মামলার হাজিরা দিতে আদালতে যান। আজ বাকিদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
বৈঠকে ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে শাহজাহান ওমর, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান, মীর নাসির উদ্দিন, বরকতউল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নাল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, শওকত মাহমুদ এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা-মনিরুল হক চৌধুরী, মশিউর রহমান, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, হাবিবুর রহমান হাবিব, লুৎফর রহমান খান আজাদ, আবদুস সালাম, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আবদুল হাই, গোলাম আকবর খন্দকার, অধ্যাপক শাহেদা রফিক, আফরোজা খানম রীতা, তাহসিনা রুশদীর লুনা, অধ্যাপক তাজমেরী এস ইসলাম, ইসমাইল জবিল্লাহ, তৈমূর আলম খন্দকার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, আতাউর রহমান ঢালী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, নজমূল হক নান্নু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সার্বিক সহযোগিতায় উপস্থিত ছিলেন চেয়ারপারসনের একান্ত সহকারী এবিএম আবদুস সাত্তার, সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন, বেলাল আহমেদ ও রিয়াজ উদ্দিন নসু। সঞ্চালক ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও দপ্তরের দায়িত্বে থাকা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক নেতা বলেন, বৈঠকে বেশির ভাগ নেতাই আন্দোলন ও সংগঠন শক্তিশালী করার পক্ষে মত দেন। মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া বোকামি। ৬ বারের এমপি হয়ে আমি নির্বাচনের সময় ঘর থেকে বের হতে পারিনি। ঘোষণা দিতে হবে, হাসিনার অধীনে ‘নো’ নির্বাচন। সংসদ বহাল রেখেও নির্বাচন হবে না। তবে আওয়ামী লীগ যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষায় কথা বলা যাবে না। কারণ ভদ্রলোকেরা বিএনপি করে, আওয়ামী লীগে ভদ্রলোক নেই।
তিনি বলেন, আমাদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো বিদেশে প্রচার হচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশ চেপে বসেছে। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন ইসু্যুতে কথা বলতে হবে। আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জোট ঠিক আছে। কিন্তু নির্বাচনি জোটের নেতৃত্বে বিএনপিকে থাকতে হবে। তবে আমাদের কূটনীতি দুর্বল। কেন নির্বাচনে যাব না তা তাদের (কূটনীতিক) বোঝাতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে আমাদের একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
শওকত মাহমুদ বলেন, আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। এক দফা এক দাবি-হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না। যে নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অংশগ্রহণ করবে না সে নির্বাচনে কেনো যাব। আগে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন, তারপর নির্বাচন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে আবার নির্বাচন হলে জামায়াত ’৮৬ ও ’৯৬ সালের মতো বিএনপি ছাড়াই নির্বাচনে চলে যাবে। তাই জামায়াতের ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এ বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হবে।
নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ‘হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। আমাদের বহির্বিশ্বে বন্ধু ও শত্রু চিহ্নিত করতে হবে। আন্দোলনের মূল শক্তি ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষক। দলকে রণকৌশল তৈরি করতে হবে।’
বর্তমান সরকারকে পুলিশ, বিদেশি ও আমলাদের সরকার বলে দাবি করে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘দেশের মানুষ নির্বাচনপাগল, কিন্তু আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, জোটের দরকার নেই। আমরা রাজপথে দাঁড়াতে পারলে সবাই আমাদের সঙ্গে আসবে। যুগপৎ আন্দোলন করাটাই ভালো। হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার আগে আমাদের রাজপথে জিততে হবে।’
শাহজাহান ওমর বীর-উত্তম বলেন, আমাদের লক্ষ্য কী? নির্বাচন। নির্বাচনে জিততে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ভীতি সঞ্চার করতে হবে। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, শ্রমিক দল ও কৃষক দল তো নেই। ঢাকা হচ্ছে সারা দেশে। ঢাকাকে শক্তিশালী করতে হবে।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে আগের নির্বাচনে যে সিট দিয়েছে এবার তাও দিবে না। তাই হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সরকার রাজনৈতিকভাবে বড় সংকটে রয়েছে। তাই জনদৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সরকার একটার পর একটা ইস্যু সৃষ্টি করছে। আমরা যদি নির্যাতন সহ্য করে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামতে পারি সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। জামায়াতের বিষয়ে অরেকজন উপদেষ্টা বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক বিবেচনা করতে হবে। জামায়াত ছাড়া না ছাড়ার বিষয়টি এইভাবে ঝুলিয়ে না রেখে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত।
উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভুঁইয়া বলেন, সংগঠন গুছিয়ে আন্দোলন-এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আন্দোলন চলবে, পুনর্গঠনও চলবে। কাজ শুরু হলে ভুলত্রুটি গুছিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।
অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে কী হয়েছে সবাই দেখেছে। দিনের নির্বাচন আগের রাতে হয়েছে। তাই দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিকল্প নেই।
জানা যায়, জোটের বিষয়ে কথা বলেন চারজন উপদেষ্টা ও দুজন ভাইস-চেয়ারম্যান। তারা বলেন, এখনই বাম ডানসহ বিরোধী সব দলের সঙ্গে কথা বলা শুরু করা উচিত। আমাদের দাবি আর তাদের দাবি প্রায় একই। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সব বিরোধী দলেরই দাবি। তাই সবাইকে এক মঞ্চে আনার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোটের শরিকদেরও সক্রিয় করতে হবে।
দুজন ভাইস-চেয়ারম্যান বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যনিবাহী কমিটি বৈঠক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনি প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশের বিষয়টি নিয়ে বিএনপির মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মানে হচ্ছে- সবাইকে (সব দলকে) অপ্রস্তুত রেখে আগাম নির্বাচনেরও একটি আভাস। ফলে এই দিকটিও বিএনপিকে মাথায় রেখে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা উচিত। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে আমাদের কী করণীয়-সেসব বিষয়ে নেতাদের মতামত নিতে এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণে দলের করণীয় সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতামত নিয়েছেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলের সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর বেশি কিছু এখন বলার নেই।